► নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও আত্মীয়করণ ► রসিদবিহীন টাকা উত্তোলন ও ভাউচার ছাড়াই ব্যয় ► কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন স্কেল বাড়ানোর নামে টাকা হাতানো
দুর্নীতির মহা উৎসবে মেতে উঠেছেন দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার গোলাম রহমান শাহ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ কাজী আব্দুল মালেক। মাদ্রাসায় যোগদানের পর থেকেই তিনি একক আধিপত্য বিস্তার করেছেন। অনুগত শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির লোকদের দিয়ে গড়ে তোলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। একের পর এক মনগড়া সিদ্ধান্ত, অদূরদর্শিতা ও নানা অনিয়মের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন তিনি। শিক্ষার মানোন্নয়নের চেয়ে নিজের আখের ঘুচাতে ব্যস্থ হয়ে পড়েন অধ্যক্ষ।
সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা জানান, উপজেলা প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত হলেও এই প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ আব্দুল মালেকেই যেন শেষ কথা। নিয়োগ বাণিজ্য, রসিদ ছাড়াই অর্থ আদায়, মাদ্রাসার জমি বন্ধক/চুক্তি দিয়ে নিজের পকেট ভর্তি করা,বেতন খুলে দেয়ার কথা বলে টাকা আত্মসাৎ, এনটিআরসিএ কর্তৃক সুপারিশকৃত দুই জন সহকারী শিক্ষকের কাছে দুই লক্ষাধিক টাকা চাঁদা দাবী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন স্কেল বাড়ানোর নামে শিক্ষকদের টাকা হাতানোসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। অধ্যক্ষের এ দুর্নীতি-অনিয়ম রোধে যেন কোন দায় নেই মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
গত জুন মাসে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে খানসামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন ওই প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতি ও বিদ্যুৎসাহী এবং দাতা সদস্য আলহাজ্ব মো.জয়নাল আবেদীন শাহ্। এর পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা
নির্বাহী কর্মকর্তা তাজ উদ্দিন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মঞ্জুরুল হক কে বিষয়টি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশনা দেন। কিন্তু তিন মাস পার হলেও এখনো
ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো গভীরভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। দ্রুতই তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
নিয়োগ বাণিজ্য ও স্বজনপ্রীতিকরণ;
অভিযোগ রয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পরই অধ্যক্ষ আব্দুল কাজী মালেক মোটা অংকের বিনিময়ে তাঁর নিজ এলাকার পরিচিত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা কর্মী, আয়া ও হিসাব সহকারী পদে নিয়োগ দিয়েছেন অথচ যদিও সেই পোস্টগুলোতে নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল স্থানীয় আশেপাশের লোকজনের। জানা যায়, তৎকালীন এই তিন পদে প্রায় ৩০ লক্ষাধিক টাকারও বেশি নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন তিনি। এছাড়াও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাম্প্রতিক মাস দুয়েক আগে মাদ্রাসার এক পিয়নের ছেলেকে ১০ লক্ষাধিক ও এক শিক্ষকের ছেলেকে ১২ লক্ষাধিক টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়।
রসিদ ছাড়াই অর্থ আদায়;
একাধিক শিক্ষক ও অভিভাবক অভিযোগ করেন, প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন পরীক্ষা, রেজিষ্ট্রেশন ও বিবিধ খরচের নামে রসিদ ছাড়াই টাকা উঠিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। স্কুলের নাম করে একটি সাদা কাগজে এসব ফি বাবদ টাকা উঠিয়ে নেন অধ্যক্ষ।
এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের সনদ দেওয়ার সময় ২০০ থেকে ৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়। এগুলো কখনোই প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে জমা হয়নি।
আজ ২৭ আগস্ট (মঙ্গলবার) সরেজমিনে মাদ্রাসা গিয়ে দেখা যায়, রশিদ ছাড়াই ৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের রেজিষ্ট্রেশন ফি নেয়া হচ্ছে। অথচ ২দিন আগেই মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা উপজেলার সকল প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনা করেছেন যেন রশিদ ছাড়া কোন আয় ব্যয় করা না হয়। রশিদ ছাড়া আয়-ব্যয়ের কারণ জানতে চাইলে অফিস কর্মচারীরা কোন উত্তর দিতে পারেননি এমনকি সেই মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে আলমারির মধ্যে থাকা পুরাতন রশিদের বই খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেয়। শেষমেষ তারা একটা রশিদ বই বের করে শিক্ষার্থীদের রশিদ দেয়া শুরু করে।
বেতন স্কেল বাড়ানো নামে টাকা হাতানো;
ভুক্তভোগী এক সহকারী শিক্ষক বলেন, ‘‘উচ্চতর স্কেলের আবেদনে টাকা ছাড়া সিগনেচার দেন না অধ্যক্ষ।
আমার কাছ থেকে বেতন স্কেল বাড়ানোর নাম করে চলতি বছরে কয়েক ধাপে মোট ৪৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অধ্যক্ষ। আমি ছাড়াও সেসময় তিনি আরএ কয়েকজন শিক্ষকের কাছ থেকে নিয়েছেন হাজার হাজার টাকা।
উপজেলা প্রশাসনের পদক্ষেপ
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আসায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওই প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতি ও বিদ্যুৎসাহী এবং দাতা সদস্য আলহাজ্ব মো.জয়নাল আবেদীন শাহ্।
এই বিষয় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এবং মাদ্রাসার ম্যানেজিং সভাপতি তাজ উদ্দিন বলেন, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আসা সব অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে উপজেলা প্রশাসনের সম্মানের বিষয়টিও জড়িত।
অভিযুক্ত অধ্যক্ষ যা বলেন;
নিয়োগের ব্যাপারে ঘটনার সত্যতা জানতে চাইলে ২৬ আগস্ট (সোমবার) রাতে অধ্যক্ষ আব্দুল মালেকের সাথে মুঠোফোনে (০১৭২০৩৩৭৮৯৭) যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন,হ্যাঁ সবগুলোই বিধিসম্মত করা হয়েছে অনিয়ম করা হয়নি আর বিধি সম্মত সরকার বিল দিত না।
নিয়োগ দেয়া বাবদ প্রার্থীদের কাছ থেকে কত টাকা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,খরচ বাবদ যা হয় তাই নেয়া হয়েছে, এইলা কি বলার অপেক্ষা রাখে.! এইলা বলার দরকার আছে..! এটাতো বলার অপেক্ষা রাখে না..! এরপর এই প্রতিবেদক মাদ্রাসার যাবতীয় আয়-ব্যয়ের ভাউচার রশিদ আছে কিনা দেখতে চাইলে তিনি বলেন,আপনাকে কেন আমি দেখাবো..! আপনাকে কোন তথ্য দিব না আমি.! আর আপনি এসব দেখার অথরিটি না, আপনি আমার বস না, টাইম আছে আপনাকে দেখার।
আজ ২৭ আগস্ট (মঙ্গলবার) সকালে সরেজমিনে মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ কাজী আব্দুল মালেক মাদ্রাসায় উপস্থিত নাই। উপস্থিতি হাজিরা খাতা চেক করলে দেখা যায় তিনি গত ২২,২৫ ও ২৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয় নি। তাৎক্ষণিক সময়ে অধ্যক্ষ আব্দুল মালেকের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে জানতে চাইলে বলেন ২৭,২৮,২৯ আগস্ট পর্যন্ত আমি পারিবারিক সমস্যার কারনে ছুটিতে আছি। কার কাছ থেকে ছুটি নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি/ ইউএনও স্যারের কাছ থেকে ছুটি নিয়েছেন। পরবর্তীতে খানসামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি তাজ উদ্দিনের কাছে বিষয়টি আলোচনা করলে তিনি ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আব্দুল মালেক কোন ছুটি দেন নি বলে জানিয়েছেন।